দেওপাড়া প্রশস্তি প্রাচীন বাংলার গুরুত্বপূর্ণ লিপিতাত্ত্বিক উৎস। বাংলার ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিলালিপিগুলোর একটি দেওপাড়া শিলালিপি ১৮৬৫ সালে দেওপাড়া গ্রামের একটি দীঘিতে আবিষ্কৃত হয়, এবং সেই জায়গার নামেই তার নাম দেওপাড়া শিলালিপি দেওয়া হয়। ১৯১৯ সালে ওই দীঘিটি সংস্কারের সময় ১২৯টি শিলা খণ্ড ও ভাস্কর্য পাওয়া যায়, যা বরেন্দ্র জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। দীঘির পাড়েই একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়, পরবর্তীতে সেটিকে প্রদ্যুম্নেশ্বরের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
লিপিটিতে কিছু অতিপ্রশংসাসূচক শ্লোক রয়েছে যেগুলি সেন রাজবংশ বিশেষত বিজয়সেনের ইতিহাসের উপর আলোকপাত করে। সেন যুগের বিখ্যাত সংস্কৃত কবি এবং লক্ষ্মণসেন এর মন্ত্রী উমাপতিধর এ প্রশস্তিলিপি রচনা করেছেন। সংস্কৃত ভাষায় রচিত এই শিলালিপিতে রয়েছে লক্ষ্মণ সেনের দাদু বিজয় সেনের গৌরবগাথা। কিন্তু আকর্ষণীয় বিষয় হলো, এই সংস্কৃত ভাষার শ্লোকগুলি লিখিত হয়েছে প্রাচীন বাংলা লিপিতে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, সেন রাজবংশ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সমান মর্যাদা দিত। এই লিপির ২২টি অক্ষরই আধুনিক বাংলা বর্ণমালার পূর্বসূরি। এছাড়াও, শিলালিপিতে বাংলার নৃত্য, সঙ্গীত ও সাহিত্যের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা সেন রাজবংশের বাংলা সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহের সাক্ষ্য দেয়।
একটি প্রস্তর খন্ডের উপর খোদিত এ লিপি রাজশাহী জেলা শহর থেকে ১০ কি.মি. পশ্চিমে দেওপাড়া নামক গ্রাম থেকে ১৮৬৫ সালে সি.টি মেটকাফ আবিষ্কার করেন। লিপিটির প্রাপ্তিস্থানের আশেপাশে বরেন্দ্র জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, নাটরের দিঘাপাতিয়ায় জমিদারপুত্র শরৎ কুমার রায়ের নেতৃত্বে পরিচালিত উৎখননের ফলে বিবিধ পাথুরের তৈরি প্রতত্বাত্তিক নিদর্শন, পুরনো দিঘি এবং প্রাচীন বাড়িঘর ও প্রদ্যুম্নেশ্বর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়।
জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল (সংখ্যা-৩৪, পার্ট-১) পত্রিকায় মেটকাফ সর্বপ্রথম শিলালিপিটি প্রকাশ করেন। পরে ইপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকার প্রথম খন্ডে প্রফেসর কীলহর্ণ লিপিটি নিয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেন।
লিপিটিতে সমান দৈর্ঘ্যের ৩২টি লাইন রয়েছে। যে পাথরের উপর লিপিটি খোদিত সেটি দৈর্ঘ্য ০.৯৭ মি প্রস্থে ০.৬ মি কিন্তু খোদিত অংশের পরিমাণ দৈর্ঘ্য ০.৮২ মি প্রস্থে ০.৪৫ মি। অপূর্ব দক্ষতা ও গভীর যত্নের সঙ্গে খোদাইকারী এটির কাজ সম্পন্ন করেন।
সম্পূর্ণ লিপিটিতে ৩৬টি শ্লোক রয়েছে যেগুলি নানা ধরনের ছন্দে রচিত যেমন
• বসন্ততিলক
• শার্দূলবিক্রীড়িত
• স্রগ্ধরা
• পৃথ্বী
• মন্দাক্রান্তা
• মালিনী
• শিখরিণী
• ইন্দ্রবজ্রা এবং
• উপজাতি।
লিপিটিতে ব্যবহূত অক্ষর আদি বাংলা অক্ষরের সঙ্গে অনেকটাই অভিন্ন। দেওপাড়া প্রশস্তিলিপির অক্ষর নিয়ে গবেষণাকারী রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সুস্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন যে, এই লিপির ২২টি অক্ষরই আধুনিক বাংলা বর্ণমালার পূর্বসূরি। । এ কারণে, দেওপাড়া প্রশস্তিলিপিটিকে আধুনিক বাংলা বর্ণমালার পূর্বসূরি বলা যেতে পারে।
শিলালিপিটিতে রাজা বিজয়সেনের রাজত্বকাল এবং বাংলার সেন রাজাদের বংশতালিকা সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। ৫-৯ নং শ্লোকে সেনগণ দক্ষিণ ভারতের কর্ণাট হতে উদ্ভূত এবং ব্রহ্মক্ষত্রিয় হিসেবে বর্ণিত হয়েছেন। ১৪-২২ নং শ্লোক বিজয়সেন চিত্রিত হয়েছেন প্রাচীন যুগের একজন মহান রাজা বা বিখ্যাত রাজা হিসেবে। এ সকল শ্লোক বলা হয়েছে, বিজয়সেন নান্য, বীর, রাঘব, বর্ধন রাজাদেরকে বন্দি এবং গৌড়, কামরূপ ও কলিঙ্গরাজকে পরাজিত করেছেন। পশ্চিমের (‘পাশ্চাত্য চক্র’) রাজাদেরকে পরাস্ত করার জন্য তিনি গঙ্গার গতিপথ ধরে একটি নৌ অভিযানও প্রেরণ করেছিলেন।
বিজয়সেন অতি উচ্চমানের এবং জাঁকজমকপূর্ণ প্রদ্যুম্নেশ্বরের মন্দির নির্মাণ করেন এবং এর নিকটে খনন করেন একটি দিঘি (শ্লোক নং ২২-২৯)।
লিপিতে এরপর বর্ণিত হয়েছে মন্দিরের অভ্যন্তরে স্থাপিত হরিহর মূর্তির বিষয়ে (শ্লোক নং ৩০-৩১) এবং সবশেষে রয়েছে প্রশস্তিলিপির রচয়িতা উমাপতিধর এবং খোদাইকারীর পরিচয়।
দেওপাড়ায় প্রদ্যুম্নেশ্বরের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের সাথে একটি ভাঙ্গা স্তম্ভ বা পিলার দেখতে পাওয়া যায়। হিন্দু ধর্মালম্বীরা তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের স্তম্ভে এখনো ভক্তিভরে ধুপ দেয়, মোমবাতি জ্বালায়।
একথা সত্য যে, দেওপাড়া প্রশস্তিতে সেন রাজা, বিশেষ করে বিজয়সেন সম্পর্কে অতিপ্রশংসামূলক বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু অতি প্রশংসার এ সুর নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, বাংলা বিজয়সেনের অধীনে ইতিহাসে এক গৌরবময় স্থান অর্জন করেছিল।
তথ্যসূত্র:
1. Epigraphia Indica, Vol. IV (1896-97) by H.C. Raychowdhury
2. The History of Bengal, Vol. I (Hindu Period), by R.C. Majumdar (1943)
3. Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. IV (Inscriptions of Eastern Bengal and Bihar), by E.H. Johnston (1942)
4. Banglar Itihas (in Bengali), Vol. I, by Suniti Kumar Chatterjee (1956